Thursday, February 29, 2024

অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্মরণে।

 মরহুম অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্মরণে।

অধ্যক্ষ এম এ বারী
ছবিটি স্যারের জৈষ্ঠ পুত্র জনাব
সাজ্জাদুল বারী’র নিকট থেকে সংগৃহীত। 
আমার প্রথম বস অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী। আজ থেকে ঊনত্রিশ বছর আগে যাঁর অধীনে শিক্ষকতা শুরু করতে পেরে আজও গর্ব বোধ করি।
আজ ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ।
বামনী কলেজ'র প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী স্যার এর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী । মরহুম বারী স্যারকে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরন করছি ।

দিনটি ছিল ১৯৯৫ সালের ২৩ জুলাই ।
আগে তাঁকে কখনও দেখিনি। সেদিনই স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা । দিনটি ছিল বামনী কলেজ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম ইন্টারভিউ। শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ হলেও আয়োজনের অবয়ব, লোকজনের উপস্থিতি, শতাধিক লোকের দুপুরে মেজবানি খাবার ব্যবস্থা এসব কিছু দেখে সেটাকে যে কেউ ছোট খাটো বিয়ে, খৎনা বা আকিকার অনুষ্ঠানও মনে করতে পারতো । বামনী কলেজের অফিসিয়াল জন্ম ১৯৯৪খ্রী.। আজকের পূর্ন যৌবনা বামনী কলেজের জন্ম হয় মূলত বামনী হাই স্কুলের পুরোনো ক্যাম্পাস'র এক পরিত্যক্ত কুড়ে ঘরে । বর্তমানে যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবন। নিজের ঘর না থাকায় অন্যের ঘরেই যার জন্ম, তার জন্ম পরবর্তী সকল অনুষ্ঠান অন্যের ঘরে হবে এটাই স্বাভাবিক । সঙ্গত কারনে প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রথম ইন্টারভিউটি অনুষ্ঠিত হয় বর্তমানের বিশাল ক্যাম্পাসে অবস্থিত বামনী হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব সফিউল্যাহ বিএসসি এর অফিস কক্ষে ।
চাকুরির পরীক্ষা বললে এটা ছিল আমার দ্বিতীয় ভাইভা পরীক্ষা । তার কিছুদিন আগে ১৬ তম বিসিএস এর মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশন ভবনে । আমার ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন পিএসসি’র চেয়ারম্যান জনাব এসএমএ ফায়েজ যিঁনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন । ঐ বোর্ডের সদস্য ছিলেন চেয়ারম্যান সহ পাঁচজন । চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কারও নামই জানা সম্ভব হয়নি । তবে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে আগে পরে আলাপকালে জেনেছি একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক, একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান, অপর দু’জনের পরিচয় জানতে পারিনি । সালাম জানিয়ে পরীক্ষার্থীর জন্য রাখা নির্ধারিত চেয়ারটিতে অনুমতি নিয়ে বসলাম। মূলত চাকরির পরীক্ষায় এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ভাইভা। সেসন জটে পড়ে সরকারি চাকরির বয়সও একেবারে শেষ প্রান্তে। ঐ সময় একজন শিক্ষার্থীর প্রতি পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের অন্যতম প্রধান চাওয়াই থাকতো শিক্ষা জীবন শেষে একটা বড় সরকারী চাকুরী পাওয়া। তাই চাকুরিটা পেতেই হবে এমন একটা মানষিক চাপ থাকায় কিছুটা নার্ভাসনেসও কাজ করছিল। চেয়ারম্যান স্যারই প্রথম শুরু করেছিলেন আমার নামের এ এস এম এর পূর্ণ রূপ জানতে চেয়ে। প্রাসঙ্গিক দু'চারটি কথার পরই সাবজেক্ট এর দক্ষতা যাচাই হলো। এটাতে তেমন খারাপ করিনি বলেই মনে হয়েছে। ধরাটা খেয়েছি ইংরেজি দক্ষতা যাচাই এর অংশে। এইচএসসি পর্যন্ত আমাদের সময় অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ইংরেজি দক্ষতা ছিল Prose ও Poetry থেকে সিলেক্টেড কয়েকটি Broad and Short Question এর Answer, কয়েকটি সিলেক্টেড Explanation, কয়েকটি Summary আর The Cow, Student Life, Aim in Life, Rainy Season এর মত কয়েকটি নির্ধারিত Eassy আর Paragraph মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেকারণে সীমিত সংখ্যক মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে Conversational English প্রয়োগে দক্ষতা প্রদর্শন করা ছিল কঠিন ব্যাপার।
প্রথম ইংরেজি প্রশ্নটাই বুঝতে পারিনি। নার্ভাস ফিল করছিলাম। চেয়ারম্যান স্যার একই প্রশ্ন বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর দিতে পেরেছি। এবার তাঁরা প্রশ্নের ধরণও পাল্টালেন। বোর্ডের সামনে প্রায় পনের মিনিট ধরে যাচাই বাছাই এর সময় যেখানে আটকে যাচ্ছিলাম সেখানেই যুবরাজের মত চেহারার অধিকারী ফায়েজ স্যার আপনজনের মতোই কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আমিও আমার পেশাগত জীবনে স্থানীয় কয়েকটি নন গভার্নমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় শুরুতে যাদের পারফরমেন্স মোটামুটি ভালো লেগেছে তাদেরকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছি। এক্ষেত্রে ফায়েজ স্যার এর আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ভূমিকার কথা সবসময় মনে পড়তো।
যাই হোক, ভাইভা পরবর্তী সময়ে মনে কিছুটা আত্মবিশ্বাস উঁকি ঝুঁকি মারছিল। তখন ইন্টারনেট ভিত্তিক মিডিয়া না থাকায় রেজাল্ট জানা যেত পিএসসির নোটিশ বোর্ড আর পরের দিনের জাতীয় পত্রিকায় । বিটিভি'র খবরে শুধু ফলাফল প্রকাশ হয়েছে বলে জানা যেত। বিটিভি'র খবর শুনেই পিএসসিতে যাই রেজাল্ট দেখতে। বর্তমানে সাতকানিয়া সরকারি কলেজে কর্মরত ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব জসীম উদ্দিন আহমেদ সহ একসঙ্গে পিএসসিতে প্রবেশ করি নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট দেখতে। জসীম ভাই সফল হলেও ভাগ্য আমার সহায় হয়নি।
১৬ তম বিসিএস ছিল সরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগের স্পেশাল বিসিএস। প্রিলিমিনারী টেস্ট, সাইকোলজিক্যাল টেস্ট কোয়ালিফাই করে তবেই ভাইভা । ছাত্র জীবনে লেখাপড়ার প্রতি আমার তেমন সিরিয়াসনেস না থাকলেও ১৪শ বিসিএস এ কোয়ালিফাই করা প্রতিবেশী মেধাবী সিনিয়র ভাই প্রফেসর আবু জাফর মোহাম্মদ সাদেক এবং ১৩ তম বিসিএস এ কোয়ালিফাই করা মেধাবী সহপাঠী প্রফেসর আবু মোহাম্মদ রহিম উল্লাহ এর সফলতা আমাকে বিসিএস এর প্রস্তুতিতে অনেকটা উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। অল্প কয়েক মাস রাত দিন পরিশ্রম করেছি কিন্তু খুব দ্রুতই টের পেয়েছি -একাডেমিক শিক্ষা জীবনের এত বড় ঘাটতি এত সময়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। আমার ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ ছিল শিক্ষা জীবন শেষ করে তারপর চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া । এটা সম্পূর্ণ ভুল কনসেপ্ট। বিসিএস ও অন্য সকল ক্যারিয়ারের পরীক্ষার জন্য একটি আউটলাইন তৈরি করে নিতে হয় এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে হয় স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা শুরুর প্রথম দিক থেকেই।
বামনী কলেজের সেদিনের শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা পরীক্ষাটা আমার কাছে ছিল ছাত্র জীবনের সাময়িক পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতির মতই সাধারণ একটা বিষয় । বোর্ডের মুখোমুখি হওয়ার ডাক পড়লে যখন কক্ষের ভিতরে ঢুকি তখন ব্যাপারটা আর মোটেই সাধারণ ব্যাপার বলে মনে হলোনা । একি ! এত লোক ! এলাহি কান্ড ব্যাপার ! প্রায় জন বিশেক বা তার কিছু বেশি লোকতো হবেই । কয়েক মুহুর্ত্বের জন্য ক্ষানিকটা ভীত হয়েছিলাম । অবশ্য দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে ভাইভার জন্য মানষিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম । ঐ মজলিশের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি যার মুখভরা পাকা দাঁড়ি, কপালে অভিজ্ঞতার অনেকগুলি ভাঁজ, ইনকরা পরিপাটি পোশাক, মাথায় অল্প পরিমান কাঁচা-পাকা চুল, চেহারায় পান্ডিত্যের ভাব, আমার স্পষ্ট মনে আছে তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি বিনম্রভাবে অনুমতি চাইলাম-বসতে পারি স্যার ? তিঁনিই বললেন হ্যাঁ বসুন । কন্ঠের আওয়াজ শুনে মনে হলো ক্লান্তি আছে কিন্ত দেখে বুঝার উপায় নেই ।

সবার দিকে একনজর তাকিয়ে আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সরকারি মুজিব কলেজের বাংলা বিষয়ের অধ্যাপক জনাব শাহজাহান স্যার, কোম্পানীগঞ্জের এযাবত কালের সবচেয়ে স্বনামধন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব মুন্সি আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুজিব কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক সফিউল্যাহ বিএসসি, নুর আহম্মদ চৌধুরী ও আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান ছাড়া আর কাউকে চিনতে পারিনি । ঐ বোর্ডে সাবজেক্ট এক্সপার্টদের মধ্যে শাহজাহান স্যারই ছিলেন সবচেয়ে সিনিয়র। আমি যাঁর অনুমতি নিয়ে বসেছিলাম শাহজাহান স্যার তাঁকেই বললেন স্যার আপনিই শুরু করুন । শাহজাহান স্যারের বলার স্টাইল দেখে আমার বুঝতে মোটেই অসুবিধা হয়নি যে তিঁনি শাহজাহান স্যারের চাইতেও বড় কিছু ।

ইত্তেফাক পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দেখেছিলাম বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, পৌরনীতি,সমাজ কল্যাণ, ইসলাম শিক্ষা, ইসলামের ইতিহাস, ব্যবস্থাপনা, হিসাববিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান এ ১২ টি বিষয়ের যেহেতু ইন্টারভিউ কল করা হয়েছে সেহেতু উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ১২ জন হবেন সাবজেক্ট এক্সপার্ট । আমার সাবজেক্ট এক্সপার্ট ছিলেন জনাব ছদরুদ্দিন আহমদ Dr-Sadruddin Ahmed তাছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, মুজিব কলেজের অধ্যক্ষ, সফিউল্যাহ বিএসসি, নুর আহম্মদ চৌধুরী ও আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান সহ আরও ৪/৫ জন । সব মিলিয়ে বিশ জনেরও অধিক। এতবড় ভাইভা বোর্ড ফেস করতে গিয়ে যে কারও হাটু কাঁপাটা স্বাভাবিক । যথারীতি ভাইভা শেষে বের হলাম । কেউ একজন বললেন দুপুরে সবার জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা আছে তাই কেউ যেন খাওয়া ছাড়া চলে না যাই । নূর আহম্মদ চেীধুরীর বাড়ীতে খাওয়ার সময় পরিচিত হয়েই মূলত বুঝতে পারি ভাইভা বোর্ডে যাদের চিনতে পারিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন বামনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জনাব এম এ বারী, সর্বজনাব মৌলভী জামাল উদ্দিন, আবু তাহের কোম্পানী, হাজী তোফাজ্জল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন লাতু ও আরও কয়েকজন । বিগত ঊনত্রিশ বছরে স্থানীয় আরো বহু মানুষকে জেনেছি যাঁদের কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
নূর আহম্মদ চৌধুরীর রাইচ মিলের মাঠে ছোট প্যান্ডেল বানানো হয়েছিল মেহমানদের খাওয়ানোর জন্য। ভিআইপিগণ আগে খাবেন এটাই স্বাভাবিক। খেতে হলে কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। একা একা অপেক্ষা করতেও ভালো লাগছেনা। কিছুটা ভীড় দেখে দেরি হবে ভেবে কৌশলে বিদায় হবার জন্যে যখন উদ্যত ঠিক তখনই পাশে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন এক প্রার্থীর দিকে নজর পড়লো। এগিয়ে হাত বাড়িয়ে পরিচিত হলাম। জানলাম তিনি ফারুখ হোসেন মোঃ নিজামী Faruk Hossain বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের প্রার্থী। সামান্য কথোপকথনে তাঁর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলাম। দু'জন এক সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় সেই গাছের নিচেই কাটালাম। আগে যারা খেয়েছেন তাদের খাওয়া পরবর্তী তৃপ্তিকর আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম ভালো আয়োজন করা হয়েছে। বামনী এলাকার আতিথেয়তার সুনাম আমি ছোটবেলা থেকেই জানতাম। চৌধুরীর রাইচ মিলের ম্যানেজার আমাদের দুজনকে খেতে ডাকলেন। আয়োজকের অনুমানের চেয়ে মেহমান বেশি হবার কারণে আমাদের শেষের কয়জনকে শুধু লাউ আর পাতলা কলাই ডাল দিয়েই খেতে হয়েছিল। আসলে রিজিকের ফয়সালাতো আসমানে হয় জমিনে নয়। দু'জন এর ধ্যান ধারণা যথেষ্ট মিল থাকায় এই সহকর্মী ফারুক ভাইয়ের সাথেই সবচেয়ে ভালো কেটেছে পেশাগত জীবনের আটাশটি বছর। ২০২৩ এর ডিসেম্বরে ফারুক ভাই আর আরেক প্রিয় সহকর্মী কাশেম মোঃ কবির উদ্দিন ভাই সুদীর্ঘ আটাশ বছরের পেশাগত জীবন শেষ করে অন্য সব সাধারণ দিনের মতোই একরকম নিরবেই অবসর জীবনে চলে যান কিন্তু বামনী এলাকার অনেকেই হয়তো বিষয়টি জানেন না। বেঁচে থাকলে আগামী বছর ৩১ ডিসেম্বর বুধবার আমাকেও বিদায় নিতে হবে। তবে সেটা সরবে নাকি নিরবে আল্লাহই ভালো জানেন।
ভাইভা বোর্ডে যাঁর অনুমতি প্রার্থনা করে বসেছিলাম তিঁনি আর কেউ নন, তিঁনি হলেন বামনী কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রথম অধ্যক্ষ অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, অনেক বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, ভীষন মজার মানুষ জনাব এম এ বারী । তিঁনি আজ আর বেঁচে নেই । আজ থেকে বাইশ বছর আগে ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী তিঁনি পরলোক গমন করেন । ৩১ আগস্ট ১৯৯৫ আমি বামনী কলেজে আনুষ্ঠানিক যোগদান করি । আমাদের বসার জায়গা বলতে যা ছিল তা হলো বামনী হাই স্কুলের পুরোনো জায়গায় অবস্থিত মাটির ফ্লোর, চারদিকে বেড়া আর টিনের ছাউনিতে তৈরি পরিত্যক্ত ঘরের দেড়শ থেকে দু’শ বর্গফুটের একটি কক্ষ । কক্ষটি ছিল অধ্যক্ষের কার্যালয় কাম শিক্ষক মিলনায়তন কাম একাউন্টস অফিস । অর্থাৎ একের ভিতর তিন । সে কক্ষে ছিল অধ্যক্ষের জন্য একটি পুরোণো টেবিল ও একটি চেয়ার, একপাশে একটি স্টীলের আলমারি, শিক্ষকদের জন্য পুরাতন লক্কর ঝক্কর হাতাবিহীন ৮/১০ টা কাঠের চেয়ার আর হিসাব রক্ষকের জন্য ছোট্র একটি পুরোনো টেবিল । কলেজের শুরুতে আর্থিক এত দৈন্য দশার মধ্যেও প্রতিদিন এক কাপ চা আর একটি খেজুরী ছিল প্রত্যেক শিক্ষক কর্মচারির ফিসিয়ালী রুটিন আপ্যায়ন। খেজুরি হলো চিনি মিশ্রিত ময়দার খামির দিয়ে তৈরি তেলে ভাজা খেজুর আকৃতির এক ধরণের পিঠা। বামনীতে সেটা এখনও পাওয়া যায়। কয়েক মাস আগে হঠাৎ মনে পড়ায় আমরা তিন সহকর্মী বামনী বাজারের আরজু হোটেলে খেতে গিয়েছিলাম।
যাইহোক, আধুনিক যুগে আমরা যেটাকে ওয়াশ রুম বলি তখন ওয়াশ রুমের বিকল্প ছিল এ ঘরটির উত্তর পাশে খোলা আকাশের নিচে কয়েকটি গাছ গাছালির আড়ালে পরিত্যক্ত ২/১ টি ওয়াল ঘেরা …….খানা । সে জায়গাটাকে আমরা সুন্দরের জন্য বাগান বাড়ি বলতাম।
বারী স্যারের সাথে যখন কর্ম জীবন শুরু করি তখন তাঁর বয়স ৬২ বছরের মত । আমাদের অনেকের বয়স ছিল তখন আনুমানিক ২৭ থেকে ৩০ এর মধ্যে । আমরা রুমে ঢুকতেই সালাম দিয়ে ঢুকতাম । আমার স্পষ্ট মনে আছে এ বয়সেও স্যার কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডসেক করতেন তারপর আমাদেরকে বসতে বলে নিজে বসতেন । আমাদের মধ্যে যারা এ ভদ্রতাটুকু শিখেছে তা এম এ বারী স্যারের কাছ থেকেই । বারী স্যার বস হয়েও বসের মত ব্যবহার করতেননা। তিঁনি আচরণ করতেন নেতার মত। ’Be a Leader, Not a Boss’ এ কথাটি জীবনে বহুবার পড়েছি এবং শুনেছি কিন্ত বারী স্যারকে বাস্তবে এমনটা দেখেছি। সেজন্য আমরা অনেকেই আগ্রহের সঙ্গে তাঁর নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকতাম। বারী স্যার ছিলেন পিতার মত দায়িত্বশীল, নেতার মত নির্দেশ দাতা, বন্ধুর মত খোলামেলা স্বভাবের।

লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা গ্রামে ১৯৩৫ সালে জনাব এম এ বারীর জন্ম । ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে অনার্স ও একই বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে এম এ পাশ করেন । পুরো কর্মজীবনই ছিলেন শিক্ষকতার সঙ্গে । জীবনে প্রায় ১০ টি কলেজে অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের যে অভিজ্ঞতা তিঁনি অর্জন করেছেন তা অন্যের জন্য ছিল অনুকরনীয়, অনুসরনীয় ও শিক্ষনীয় । ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের ছাত্র এবং শিক্ষক হলেও প্রায় সকল বিষয়েই তাঁর দখল ছিল ।
১৯৯৪ সালের সে জীর্নশীর্ন কুড়েঘর থেকে বামনী কলেজ আজ অট্রালিকায় । বামনী কলেজের এমন সুদিন দেখলে দুর্দিনের কান্ডারী বারী স্যার নিশ্চয়ই খুশি হতেন । আজ বামনী কলেজের অনেক কিছু আছে কিন্ত নেই বারী স্যার, আরও নেই বামনী কলেজের দুর্দিনের আরও কয়েক বন্ধু মরহুম সফিউল্লাহ বিএসসি, মরহুম নূর আহম্মদ চৌধুরী, মরহুম আলী আহম্মদ চেয়ারম্যান, মরহুম মৌলভী জামাল উদ্দিন, মরহুম আবু তাহের কোম্পানী, প্রমূখ।
বামনী এলাকার প্রবাসী আমেরিকানদের আর্থিক অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় এ কলেজটি। বাবু রমেশ চন্দ্র মজুমদার ও জনাব হাবিব উল্যাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সর্বজনাব প্রফেসর এ এন এম বিল্লাহ, কামরুজ্জামান মিয়া, মৌলভী জয়নাল,আবু নওশাদ, ইকবাল বাহার চৌধুরী সহ আরও অনেক প্রবাসীর নাম শুনা যেত কলেজ প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আলোচনা আসলেই।

বারী স্যারের হাত ধরে শুরু হওয়া সময়কাল থেকে টানা ঊনত্রিশ বছর এ পেশায় আছি। কলেজের শুরুতে শিক্ষার্থীর কোয়ানটিটি ছিল কম কিন্ত কোয়ালিটি ছিল বেশি। এখন কোয়ানটিটি বেড়েছে কিন্ত ধ্বস নেমেছে কোয়ালিটিতে। ব্যবস্থাপনার ছাত্র হিসেবে সব কিছুতে সবার আগে ব্যবস্থাপনাকে দেখার অভ্যাস (কারও কারও মতে বধ অভ্যাস) আমার শিক্ষা জীবন থেকেই। ২৮-২৯ বছরের পেশাগত জীবনে বহু রুপের ব্যবস্থাপনা দেখেছি। যেটিকে আমার শিক্ষার সঙ্গে মিলাতে পেরেছি সেটিকে সমর্থন করেছি আর যেটি সমর্থনযোগ্য নয় সেটি ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেনে নিয়েছি।

কি পাওয়ার কথা ছিল? কি পেয়েছি? যা পেয়েছি তা কিভাবে পেয়েছি? যা পাইনি তা কেন পাইনি? এসব ছোট ছোট প্রশ্নের বড় বড় উত্তর আছে। বৈচিত্র না থাকলেও ২৮/২৯ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা নেহায়েত কম নয়। এ সময়ের ময়না তদন্ত করলে তার রিপোর্ট দিয়ে রীতিমত একটি ছোটখাটো উপন্যাস লেখা যাবে।

দুঃখ প্রকাশঃ

প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের অবতারনা করতে গিয়ে লেখাটির অবয়ব বৃদ্ধি হয়েছে যা হয়তো সম্মানিত পাঠককের বিরক্তির কারণ হতে পারে। আশাকরি সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

শেষকথাঃ

মরহুম এম এ বারী ছিলেন আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বিনয়ী, সদালাপী, বন্ধুভাবাপন্ন, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, ধর্মপরায়ন ও একজন মজার মানুষ । এমন একজন গুনীজনের সান্নিধ্যে অল্প ক’টা দিন থাকতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত ধন্য মনে করছি। আজ ২৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরহুম এম এ বারী স্যারের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি । একই সঙ্গে বামনী কলেজ পরিবারের যেসব সদস্য পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাঁদের কর্মের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি । প্রার্থনা করছি আল্লাহ যেন তাঁদের সকলকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করেন । আমীন।

[ লেখকঃ এ এস এম কামাল উদ্দিন ]

বি. দ্র. - লেখাটি ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ আমার ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য লেখা হয়েছিল। আরও অধিক পাঠকের পড়ার সুবিধার্থে লেখাটি আমার এ ব্যক্তিগত ব্লগেও পোস্ট করে রাখা হলো।

Wednesday, September 20, 2023

মিথ্যার রুপ অনেক, কিন্তু সত্যের রুপ একটাই।


থ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্রতায় ভরা বিশ্বে, সত্যের সাধনা একটি মহৎ অথচ অধরা প্রচেষ্টা। এটা প্রায়ই বলা হয় যে "মিথ্যার অনেক রং আছে, কিন্তু সত্যের একটাই রং আছে।" এই রূপক অভিব্যক্তি মিথ্যার জটিলতার দিকে ইঙ্গিত করে, যা অসংখ্য রুপে প্রকাশিত হতে পারে, যেখানে সত্য অবিচল এবং অটল থাকে এবং একক রুপে প্রতিনিধিত্ব করে। এই নিবন্ধে, আমরা এই রূপকের গভীরতা অন্বেষণ করব, মিথ্যার সূক্ষ্মতা, সত্যের সরলতা এবং আমাদের ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত এবং তথ্য-সমৃদ্ধ সমাজে সত্য ও মিথ্যা উভয়ের প্রতি আকর্ষণ ও বিকর্ষণের মাত্রাগত পার্থক্যের কারণ সন্ধান করার চেষ্টা  করব।

মিথ্যা, একটি বিশাল বর্ণালীর মত রং এবং রুপের ব্যাপক পরিসর । এটি সাদা মিথ্যা এবং অতিরঞ্জন থেকে শুরু করে ব্যাপক প্রতারণা এবং প্রতারণামূলক প্রচারের সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই বর্ণালীতে বিভিন্ন উপায়ে মিথ্যা আমাদের জীবনে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে ।

বর্ণালীর শুরুতে আমরা নিরীহ সাদা মিথ্যা (Innocuous white lies) খুঁজে পাই যা আমরা কারো অনুভূতি রক্ষা করতে বা অপ্রয়োজনীয় দ্বন্দ্ব এড়াতে ব্যবহার করে থাকি। এগুলি খারাপ নয় বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা আসলে মূল বিষয়কে সত্য থেকে বিচ্যুত করার প্রতিনিধিত্ব করে, দেখানোর চেষ্টা করা হয় যে এসব সাদা মিথ্যার ক্ষতি না হয়ে ভাল কিছু হতে পারে।

মিথ্যার বর্ণালী বরাবর চলমান থাকলে সেখানে সত্যের উপাদানগুলি ব্যক্তিগত বা অপ্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রসারিত বা অলংকৃত করা হয় যেখানে অন্যেরা অতিরঞ্জনের সম্মুখীন হয় । মিথ্যার এই ছায়াগুলি প্রায়শই সত্য এবং কল্পকাহিনীর মধ্য রেখাকে ঝাপসা করে দেয়, এ কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসত্য থেকে সত্যকে আলাদা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।

মিথ্যার বর্ণালীতে ক্রমশ ইচ্ছাকৃত প্রতারণাবং ভুল তথ্য প্রচার একটা রুটিনে পরিনত হয়, যেখানে মিথ্যা আরও গাঢ় এবং অশুভ রং ধারণ করে। এটি স্বীয় বা গৌষ্টি স্বার্থ হাসিল করতে, জনমতকে প্রতিষ্ঠিত করতে, বিরোধের বীজ বপন করতে বা ক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইন্টারনেটের যুগে, মিথ্যার এই গাঢ় ছায়াগুলি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা উল্লেখযোগ্য পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সত্য সবসময়ই সরল। মিথ্যার যাদু-নল (Kaleidoscope) এর বিপরীতে সত্য সরলতার আলোকবর্তিকা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। একক রঙের মত সত্য অটুট এবং অপরিবর্তনীয়। এটি অলঙ্করণ বা বিকৃতির প্রয়োজন নেই

সত্য ব্যাখ্যা বা হেরফের সাপেক্ষে নয়। এটি দৃষ্টিকোণ বা অভিপ্রায়ের উপর নির্ভর করে রুপ পরিবর্তন করে না। এটি সেই ভিত্তি যার সঙ্গে বিশ্বাস, সততা এবং অর্থপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। অনিশ্চয়তায় ভরা পৃথিবীতে, সত্য একটি স্থিতিশীল ভিত্তি প্রদান করে যার উপর আমরা  সিদ্ধান্ত নিতে পারি ।

সত্যকে সত্য রুপে নিরুপন করা সত্যিই একটি চ্যালেঞ্জ। "মিথ্যার অনেক রঙ আছে, কিন্তু সত্যের রং মাত্র একটি "-এ ধারণাটি মিথ্যা এবং সত্যের মধ্যে বৈসাদৃশ্যকে হাইলাইট করে, এটি দুটিকে বোঝার ক্ষেত্রে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হই তাও চিহ্নিত করে। তথ্য, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিতে প্লাবিত পৃথিবীতে মিথ্যাবাদীর কথাসাহিত্য থেকে সত্যকে আলাদা করা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছে।

 
প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি হল আনুগত্যের পক্ষপাতিত্বআমাদের বিদ্যমান বিশ্বাসকে নিশ্চিত করে এমন তথ্যেকে গ্রহন করার পক্ষে আমাদের প্রবণতা। এই পক্ষপাতিত্ব আমাদের মিথ্যাকে গ্রহণ করতে পরিচালিত করে যা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ । পক্ষপাতিত্বের কারণে আমরা প্রায়শই অসুবিধাজনক সত্যকে প্রত্যাখ্যান করি।

সমাজে সত্যের অপরিহার্যতার বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ন।  এমন একটি বিশ্বে যেখানে মিথ্যার আধিক্য রয়েছে সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সমাজে সত্যের অপরিহার্যতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যায় না। 

গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা এবং সামাজিক সংহতির ভিত্তি হিসাবে সত্য ই গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালনকারী উপাদান। কিন্ত যখন সত্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তখন বিশ্বাস ভেঙে যায় এবং সমাজের ভিত্তিও ভেঙে যায়।

বিশেষ করে বর্তমান ইন্টারনেটের যুগে মিথ্যা তথ্যের পরিণতি বিধ্বংসী হতে পারে। ভুল তথ্য স্বাভাবিক চিন্তাকে প্রভাবিত করতে পারে, সহিংসতা উসকে দিতে পারে এবং জনস্বার্থকে দুর্বল করতে পারে

সত্যের সংস্কৃতি গড়ে তোলা মিথ্যার সমূদ্র থেকে সত্যের জহরত তুলে আনতে হলে আমাদের অবশ্যই এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যা সততা, স্বচ্ছতা এবং সত্যের সাধনাকে মূল্য দেয়। তথ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখতে প্রতিটি ব্যক্তির ভূমিকা রয়েছে। এর জন্য অবশ্যই নৈতিকতা বোধ শিক্ষা ও নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। এটি ব্যক্তিগত দায়িত্ব দিয়ে শুরু হয়।

 

Friday, December 7, 2018

একটি মোবাইল, অনেকগুলি দুর্ঘটনা | প্রসঙ্গঃ অরিত্রি’র আত্মহত্যা |


১৯৭৫
সালের কথা আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি প্রধান শিক্ষক ছিলেন জনাব আবদুল হালিম যাঁকে সবাই একজন নীতি পরায়ন, যোগ্য এবং সুশিক্ষক হিসেবেই জানতো | সে বছর স্কুলের কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য বালি এনে স্কুল ক্যাম্পাসে একটি একতলা বিল্ডিং এর ছাদে রাখা হয়েছে | আমারই একজন সহপাঠি বিরতির সময় বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে খেলার ছলে পা দিয়ে বালিগুলি নিচে ফেলছে | প্রধান শিক্ষক হালিম স্যার এটা দেখে তাকে সেখান থেকে ধরে এনে দশ বেত লাগিয়েছেন | ছাত্রটি কান্না করতে করতে বাড়িতে গেলে তার জেঠা কিছুক্ষনের মধ্যেই ধেয়ে এসে লাঠি দিয়ে প্রধান শিক্ষককে আঘাত করেন | তার পর অবশ্য ব্যক্তির যে কঠিন শাস্তি হয়েছিল তা এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম |
১৯৭৬ সালের কথা | আমি বসুরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র | তৎকালীন এমপি জনাব আবু নাছের চৌধুরীর কন্যাও ছিল আমাদের সহপাঠী | বাবু পুর্নেন্দ্র শেখর পাল (পুর্নেন্দ্র বাবু স্যার) আমাদের বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন| যারা পুর্নেন্দ্র বাবু স্যার এর স্টুডেন্ট তারা ভাল করেই স্যারের শাস্তি সম্পর্কে জানেন | বাড়ির কাজ-পরদিন ২০ টি তৎসম উপসর্গ (প্র, পরা, অপ, সম, নি, অব, অনু, নির, দূর, বি, অধি, সু, উৎ, পরি, প্রতি, অভি, অতি, অপি, উপ, ) মুখস্ত করে আসতে হবে নাহলে কঠিন শাস্তি| প্রধান শিক্ষক শ্রদ্ধেয় মোশারফ হোসেন (মশু মিয়া) স্যারের স্কুলে সকল বিষয়ের পড়াই ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ন | আটটি বিষয়ের পড়া আবার তারসঙ্গে জটিল কঠিন বিদঘুটে বিশটি উপসর্গ মুখস্ত করে ধরে রাখা বয়সে কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি |
পরদিন পুর্নেন্দ্র বাবু স্যার ক্লাসে ঢুকলেন| পিন পতন নিরবতা| যারা পড়া শিখে আসেনি তাদের দাঁড়াতে বললেন |এক সঙ্গে ক্লাসের ছাত্র ছাত্রী সবাই দাঁড়ালো | ক্যাপ্টেনকে পাঠিয়ে দুটি বেত আনালেন | দুটি বেত একসঙ্গে করে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবার দুইহাতে স্যারের সর্বশক্তি দিয়ে চারটি করে বেত মারলেন | কোন স্বজনপ্রীতি নেই | বেত্রাঘাত থেকে বাদ যায়নি এমপি কন্যাও কিন্ত এমপি সাহেবকে টু শব্দটিও করতে শুনিনি |একজনের হাত ফেটে একটু রক্তও বের হয়েছিল | পুর্নেন্দ্র বাবু স্যার এর সে বেত্রাঘাতই আমাকে ২০ টি উপসর্গ মুখস্ত করতে বাধ্য করেছিল যা আমি আজও আধা নিঃশ্বাসে মুখস্ত বলতে পারি | স্যার এর বেতের আঘাত খাওয়া কোন শিক্ষার্থী দুঃখে, কষ্টে বা লজ্জায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়নি | তাঁর অনেক ছাত্র আজও রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ন পদে আসীন আছেন |

গতকাল আমার কলেজের অভ্যন্তরীন পরীক্ষার ইনভিজিলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম | প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত একশ আঠারো জন পরীক্ষার্থী যাদের সকলেই ছাত্রী | যে কক্ষটিতে তিনশ শিক্ষার্থী এক সঙ্গে বসে ক্লাস করতে পারে সে কক্ষটির আয়তন সবার কাছে সহজেই অনুমেয় হওয়ার কথা | কক্ষে আমরা তিনজন ইনভিজিলেটর | ক্লাস নিয়ন্ত্রন আর পরীক্ষা কক্ষ নিয়ন্ত্রনের মধ্যে যে বেজায় পার্থক্য রয়েছে সে বিষয়ে কম-বেশি সকলেরই বুঝবার কথা | বিগত কয়েক বছর ধরে অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে যখন থেকে পাবলিক পরীক্ষার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তখন থেকেই নানা কারণে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক সহ কম বেশি সকল পক্ষই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শিক্ষায় অসাধু কর্মকান্ডকে সমর্থন করতে শুরু করেছেন | একই ধরনের পরিবেশের মধ্য দিয়ে যেসব শিক্ষার্থী জেএসসি, এসএসসি পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায় এসেছে তারা অনুগত শিক্ষার্থীর মত পরীক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে পরীক্ষা দেবে এমনটি আশা করা বাতুলতা মাত্র | প্রায় তেইশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে পরীক্ষার দায়িত্ব যেভাবে পালন করেছি গতকালের দায়িত্ব সেভাবে পালন করতে পারিনি | মনে কিছুটা সাহস হারিয়েছি | কারণ একটাই, ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যা এবং অতঃপর…..
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় সকলের মত আমিও মর্মাহত | শুধু একজন শিক্ষক হিসেবে নয়, শুধু একজন অভিভাবক হিসেবে নয়, একজন পিতা হিসেবে আমি অত্যন্ত মর্মাহত | আমার বড় মেয়েও ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী | অরিত্রির বয়সী আমার অপর মেয়ে মতিঝিল গভঃ গার্লস হাই স্কুলের নবম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে | জেএসসি পাশ করার পর আমার এবং আমার স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল তাকেও ভিকারুননিসায় নবম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য চেষ্টা করবো | কিন্ত স্কুল কলেজের প্রভাতী দিবা শাখার কারণে আমার দুই মেয়ে একসঙ্গে আসা যাওয়ার সিডিউলটা মেলানো যায়নি বলে আমরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মতিঝিল গভঃ গার্লস হাই স্কুলের নবম শ্রেণিতে ভর্তির আবেদন করি |
অরিত্রি আমার মেয়ের মত | শুনেছি শিক্ষক কর্তৃক তার পিতা-মাতাকে অপমানের বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দিয়েছে | বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয় বিদারক | কিন্ত কেন এই আত্মহত্যা ? পৃথিবী থেকে একবার চলে গেলে আর ফেরা যায়না অরিত্রি কী এটা বুঝতোনা ? যার জীবন বলতে গেলে মাত্র শুরু, সুন্দর পৃথিবীকে উপভোগ করা যার এখনও শুরুই হয়নি সে কেন সব কিছু ছেড়ে অকালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ? অরিত্রি নিঃসন্দেহে মেধাবী মেয়ে | মেধাবীরাতো নিজের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক স্বপ্ন আঁকে | মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে থাকে এদের অনেক স্বপ্নগাঁথা | সমাজ বিনির্মানে এদের থাকে অনেক পরিকল্পনা | দেশ গঠনে এদের থাকে অনেক কাল্পনিক প্রতিশ্রুতি | তাহলে অরিত্রির তো এসব স্বপ্ন থাকার কথা | এক জীবনে একজন মানুষ পৃথিবীর জন্য কত ভাল কিছু করে নিজেকে অমর করে যেতে পারে সেসব মানুষের কাহিনী কী সে শুনেনি? আত্নহত্যা করলে কি হয় তা বয়সে তার জানার কথা, অরিত্রির পিতা-মাতার সঙ্গে তার কী কোনদিন কোন প্রসঙ্গেই এসব নিয়ে গল্প হয়নি? বয়সে যেটুকু ইমোশন থাকার কথা সে কি তার চেয়েও বেশি ইমোশনাল ছিল? এসব নানা প্রশ্ন যখন আমার মাথায় আসছিল তখন ভাবছিলাম সে যদি আমার মেয়ের ক্লাসমেট হতো তাহলে সেদিন যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে হয়তো আরও সঠিক তথ্য জানার সুযোগ হতো |
অরিত্রির অপরাধ পরীক্ষা কেন্দ্রে মোবাইল নিয়ে আসা | আমার মেয়ের পড়ার সুবাদে প্রতিষ্ঠানটির কিছু নিয়ম কানুন সম্পর্কে আমারও জানা হয়েছে | আমি আমার মেয়েদেরকে একটি গ্রহনযোগ্য স্বাধীন অথচ শৃংখলার পরিবেশের মধ্যে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি | জানিনা সেকারণে হয়তো সে ভিকারুননিসার অধিকাংশ নিয়ম কানুন, শিক্ষকদের শিক্ষাদান পদ্ধতি শিক্ষার মানকে সমর্থন করে যা ইদানিং অন্যেরা সমালোচনা করছে | পরিস্থিতির কারণে আমিও চাই আমার মেয়ের কাছে একটি মোবাইল থাকুক যাতে সে কলেজে পৌঁছেই বাসায় জানিয়ে দিতে পারে | বাসায় আসতে দেরি হলে যেন ফোন দিয়ে জানতে পারি সে অমুক জায়গায় জ্যামের মধ্যে আছে | কিন্ত নিয়ম ভঙ্গ করে আমার মেয়ে মোবাইল নিতে চায়না বলে সেটা সম্ভব হয়নি | আমি ভেবে দেখলাম যদি নিয়মটি না থাকতো তাহলে প্রতিষ্ঠানটির পনের হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে মোবাইল আনা থেকে জন বিরত থাকতো? অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির শৃংখলা, পড়া-লেখার পরিবেশ এগুলি কোথায় গিয়ে পৌঁছতো? তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে থাকুক বা না থাকুক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মোবাইল নিয়ে না আসার নিয়মতো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার জন্য, শিক্ষার্থীর জন্য, শিক্ষার মানের জন্য,শিক্ষার পরিবেশের জন্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে এটা সকল সচেতন মহলই সমর্থন করার কথা |
বর্তমানে শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পাওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণের মধ্যে মোবাইল অন্যতম | আমি যতদূর জানি শুধু ভিকারুননিসা নয় শহরের নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল নিয়ে ক্লাসে আসা একটা অপরাধ | কিন্ত যদি কেউ অপরাধ করে তাকে প্রথম দফায়ই টিসি দিয়ে বিদায় দেয়ার মত শাস্তি অবশ্যই অমানবিক | তাই শিক্ষার্থীকে কোন অন্যায়ের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর মান সম্মানবোধ, বয়স এসবকিছু বিবেচনা করা উচিত এটাও ঠিক যে আমাদের কিছু শিক্ষক আছেন যারা নানা কারণে ইচ্ছা করেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক সুলভ আচরণ করেননা একজন সুশিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীদেরকে নিজের সন্তানের মত বা নিজের ভাই বোনের দৃষ্টিতে দেখা শিক্ষক হিসেবে শুধু শাসক হওয়ার মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। কাউন্সেলিং করে একজন বিপথগামীকে পথের দিশা দিতে পারাই একজন প্রকৃত শিক্ষকের কৃতিত্ব। শুনেছি অরিত্রিকে পরীক্ষার কক্ষে মোবাইল আনার অপরাধে কর্তৃপক্ষ টিসি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় এবং তার সামনে তার পিতামাতাকে অপমান করা সহ্য করতে না পারার আবেগই তাকে আত্মহত্যার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে | তাই যদি সত্য হয় তবে একজন সত্যিকার শিক্ষকের নিকট থেকে এমন আচরণ মোটেই কাম্য নয়
বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়েছে, শুনেছি প্রতিষ্ঠান প্রধান সহ তিনজন শিক্ষক বরখাস্ত হয়েছেন, শ্রেণি শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়েছেন | অনেক দাবি নিয়ে শিক্ষার্থী অভিভাবকগণ আন্দোলন করছেন | কেউ হয়তো ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেয়ার সুযোগ নিতে চেষ্টাও করছেন | ফেসবুকে কিছু মানুষ প্রতিষ্ঠানটির নাম নিয়ে পাকিস্তানের গন্ধ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন | সত্যিই সব কিছুই দুর্ভাগ্যজনক | শুধু ভিকারুননিসা নয় ঐতিহ্যবাহী এবং স্বনামধন্য যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে হুটহাট মন্তব্য করা উচিত নয় | কারণ এর সঙ্গে জড়িত থাকে অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের অনেক সাফল্য গাঁথা, অনেক স্বপ্ন গাঁথা | প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহন করে যারা বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পেশায় অনেক উঁচু স্থানে নিজেদেরকে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছেন প্রতিষ্ঠানটির ভাবমুর্তি নষ্ট হলে তাদের হৃদয়কেও ব্যথিত করবে | ব্যক্তি দোষকে প্রতিষ্ঠানের সম্মানের সঙ্গে একাকার করা উচিত নয়| ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল, বুয়েট সহ যেসব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করার অনেকের স্বপ্ন থাকে ভিকারুননিসাও তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান | এতকিছুর পরও দেখবেন আগামী বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক ভর্তির স্বপ্নের তালিকায় ভিকারুননিসাকে প্রথম দিকেই রাখবেন |
মামলাধীন বিষয়টির সঠিক তদন্ত হোক, সত্যিকার দোষী ব্যক্তি শাস্তি পাক এটাই কাম্য | একই সঙ্গে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, প্রতিষ্ঠান প্রধান তথা শিক্ষককে বরখাস্ত, বেতন বন্ধ, গ্রেপ্তার ইত্যাদি কারণে যদি ভবিষ্যতে শিক্ষর্থীকে ন্যুনতম নিয়ন্ত্রন করতে শিক্ষকগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তাহলে শিক্ষায় মহা বিপদ দেখা দিতে পারে, গতকাল আমি যেমনটা হারিয়েছিলাম | আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, ঘটনার জন্য গৃহীতব্য সম্ভাব্য ব্যবস্থা সঠিক না হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যদি শিক্ষর্থীগণ অবাধে মোবাইল নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে অনুপ্রাণিত হয় তাহলে শিক্ষা এবং শিক্ষার পরিবেশের নিশ্চিত সর্বনাশ ঘটবে |একটি মোবাইল অনেক বিপদের জন্ম দিয়েছে | ভবিষ্যতে কোন মোবাইল যেন অনেক সর্বনাশের কারণ না হয় এটাই কাম্য | অরিত্রি আত্মার শান্তি কামনা করছি | অরিত্রি পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি |
লেখকঃ এস এম কামাল উদ্দিন (কলেজ শিক্ষক)